পদ্মফুল থেকে উৎপাদিত বিলাসবহুল ‘পদ্মরেশম’: বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা
পদ্মফুল শুধু সৌন্দর্যেই নয়, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিক থেকেও এক বিস্ময়। এর ডাঁটার ভেতরে থাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র কূপ, যেখান থেকে এক ধরনের আঠালো পদার্থ সংগ্রহ করা হয়। বাতাসের সংস্পর্শে এলে এই পদার্থ শুকিয়ে যায়, এবং তা পাকিয়ে তৈরি হয় বিশেষ এক ধরনের সুতা। এই সুতাকে বলা হয় ‘লোটাস সিল্ক’ বা পদ্মরেশম।
এই সুতা শুকাতে রোদ লাগে না—বাতাসেই শুকিয়ে যায়। সুতা থেকে তৈরি কাপড়ের রঙ হয় হালকা দুধে-হলুদ। বিশ্বজুড়ে লোটাস সিল্ক পরিচিত এক বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে। এক কেজি পদ্মরেশম সুতার বাজারদর ২,০০০ থেকে ৩,৫০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর প্রতি গজ কাপড়ের দাম পড়ে ২৫ থেকে ১,০০০ ডলার পর্যন্ত।
পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় লোটাস সিল্কের উৎপাদন ও ব্যবহার বহু পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এটি একেবারেই নতুন উদ্যোগ।
গোলাপি পদ্ম (Nelumbo nucifera) এর ডাঁটা থেকে সুতা তৈরি করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্রাকৃতিকভাবে এটি কোমল, মসৃণ, বায়ু চলাচলকারী ও জলরোধী। সুতি বা মালবেরি সিল্কের তুলনায় এটি বেশি টেকসই হলেও প্রসারণ ক্ষমতা কিছুটা কম। তবে রং খুব ভালোভাবে ধরে এবং সহজে কাটা যায়। সুতার উৎপাদনে পানি বা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হয় না, ফলে এটি পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণহীন। এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না, যা প্রাণিবান্ধবও বটে।
বাংলাদেশে সরকারি মালিকানাধীন অন্তত ৩৫ থেকে ৪০টি পদ্মবিল রয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগেই সারা বছর পানি থাকে। এই বিলগুলো থেকে পদ্ম সংগ্রহ সম্ভব, বিশেষ করে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, যেটি সুতার জন্য উপযুক্ত মৌসুম। একটি ডাঁটা কেটে নিলেও তা পানির নিচে প্রতিদিন ৬–৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়ে, ফলে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচবার পর্যন্ত ডাঁটা সংগ্রহ করা যায়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যেখানে কম্বোডিয়া বা ভিয়েতনামে এক কেজি সুতা তৈরিতে প্রায় ৩০ হাজার পদ্মের ডাঁটা লাগে, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১৫ হাজার ডাঁটায় সম্ভব হচ্ছে সমপরিমাণ সুতা উৎপাদন।
‘পদ্মফুলের বৈচিত্র্য, ব্যবহার উপযোগিতা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিপিআরডি। প্রকল্পটির পরামর্শক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রাখহরি সরকার। বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই প্রকল্পে সহযোগিতা করেছেন কমিশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মো. তাজউদ্দিন।
সুতা কাটায় সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের অপারেশনস ম্যানেজার মো. মঞ্জুরুল ইসলাম ও মসলিন প্রকল্পের সহায়ক মো. মোহাইমিনুল ইসলাম। ফরিদপুরের কানাইপুরের রনকাইল গ্রামের নারীরা মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণেই সুতা কাটায় দক্ষতা অর্জন করেন। আর সোনারগাঁয়ের অভিজ্ঞ কারিগর আছিয়া বেগম সেই সুতায় বুনেছেন একখানা ছয় গজের বিশেষ স্কার্ফ।
এই স্কার্ফটি বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে। এটি শুধু একটি কাপড় নয়, বরং বাংলাদেশের নবাগত সম্ভাবনার প্রতীক, যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।